banner
kabinbd

ঘরে-বাহিরে নারীরা নিরাপদ হবে কি ভাবে ?

বাংলাদেশের নারীরা কোথায় নিরাপদ? ঘরে-বাইরে, পরিবারে, লোকালয়ে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান কিভাবে ঘটবে,

এ প্রশ্নের জবাব কেউ জানে না।

জনসংখ্যার অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে এ প্রশ্নের উত্থাপন একটি কঠিন বাস্তবতার জন্ম দেয়- নারী কি আসলেই মানুষ হিসেবে বিবেচিত; না পুরুষের প্রদত্ত ফতোয়া’র অধীনে।

বাংলাদেশের সমাজে পুরুষরাও বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত হয়। অনেক নিয়ন্ত্রণই তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নারীর ওপর বাড়তি নিয়ন্ত্রণ হিসেবে চেপে বসে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্বপরায়ণতা।

রাজনৈতিক স্লোগানে বাংলাদেশের নারীর জীবন অনেকাংশে নিশ্চিত হলেও বাস্তব চিত্রটি পুরোপুরি আলাদা। এখানে ভিন্নমতের প্রতীকে ভোট দেয়ার কারণে নারী গণধর্ষিত হয়, সামান্য কারণে শিকার হয় হিংসার।

নারীর বিরুদ্ধে হিংসা যে রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করেছে, আজ তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন নারী অধিকার ও মানবাধিকার কর্মীরা রাজনৈতিক বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হন, প্রতিবাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। তাই নারীর লাঞ্ছনা, নির্যাতন জাতীয় পর্যায়ে আজ উপেক্ষিত।

নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজের বিভিন্ন পরিমণ্ডলে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজে বহুল আলোচিত; কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনা করে তর্কে জেতা যাবে হয়তো, সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত নারীর প্রতি সহিংসতার সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার ৬৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।

এই পরিসংখ্যানের মধ্যে নির্বাচনোত্তর সময়ে নোয়াখালীতে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তা অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও মানবাধিকার কমিশন শুরুতে এই বলে সাফাই গাইতে চেষ্টা করেছিল যে, এই ধর্ষণের সঙ্গে নির্বাচনী সহিংসতায় কোনো সম্পর্ক নেই।

পরে অবশ্য তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বর্তমানে নারী ও কন্যাশিশুরা উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ২৮৩টি শিশু নিহত হয়েছে।

key word: divorcee matrimony in Bangladesh

শুধু যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৪টি শিশু। ৫ বছরের একটি কন্যাশিশু যখন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তখন পুরো বিষয়টি মানুষের বিবেককে আহত করে কিনা জানি না; কিন্তু এ ধরনের মানুষদের প্রকাশ্যে কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত।

মৃত্যুদণ্ড গ্রহণযোগ্য না হলেও এসব অপরাধে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ায় ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে যে বিধান রয়েছে, তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের পর বর্তমান বছরের শুরু থেকে কন্যাশিশু ধর্ষণের হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। কয়েকদিন আগে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় ধর্ষণচেষ্টার পর একসঙ্গে দুই শিশু হত্যার ঘটনা নাড়া দিয়েছে অনেককে।

ঘটনার দিন ৭ জানুয়ারি ঘরের সামনে খেলছিল দুই শিশু দোলা ও নুসরাত। তাদের লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফ্ল্যাটে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে আজিজুল ও মোস্তফা নামের দুই দুর্র্বৃত্ত। ভয়ে ওই শিশুরা চিৎকার শুরু করলে ক্যাসেট প্লেয়ারে সাউন্ড বাড়িয়ে চলে ধর্ষণচেষ্টা। ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধ করে দুই শিশুকে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

পুলিশ অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে ওই দুই দুর্বৃত্তকে গ্রেফতার করেছে। এই দুই শিশু সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু তাদের ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে এ সমাজ এগিয়ে আসেনি।

বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমরা উচ্চকণ্ঠ হলেও এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে পারি না। এসব বিষয়ে সরকারি দলের নীরবতা বুঝতে পারি; কিন্তু বিরোধী দল, নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নীরবতার কারণ বুঝতে পারি না। পুলিশের লাঠিপেটার ভয়ে যদি বিরোধী দল এসব প্রশ্নেও নীরব থাকে, তাহলে তারা জনসমর্থন প্রত্যাশা করে কিভাবে?

নারী যে শুধু যৌনতার কারণে হিংসার শিকার হয়, এমনটি নয়। একটি পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য যদি গুম অথবা খুন হয়, তাহলেও সেই নারীর জীবনে নেমে আসে নীরব ও সরব নির্যাতন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড; বিশেষ করে ক্রসফায়ার, বন্দুক যুদ্ধ, গুলিবিনিময়, গুম, খুন, হত্যা ঘটনা অব্যাহত ছিল।

এসব ঘটনায় ৪৬৬ জন নিহত হয়েছে। ২০১৮ সালের আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল বেআইনি আটক, গণগ্রেফতারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনা। ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করা হয় ৩৪ জনকে।

এসব ঘটনায় কোনো দল বা পরিবার যত না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীরা। পিতা অথবা স্বামীর অবর্তমানে কন্যা ও স্ত্রী পতিত হয় চরম অনিশ্চয়তায়। ভাইয়ের অপহরণে চোখের জলে ভাসে বোন। যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুর মৃত্যুতে পাগল হয়ে যান মা। নারীর প্রতি যৌন হিংসার পরিবর্তে এসব বিষয়ও নারীকে অনেক বেশি অনিরাপদ করে তোলে।

আমাদের সমাজে নারীরা বিভিন্নভাবে প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এই নির্যাতনের অভিযোগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউই মুক্ত নন। ঘরের বাইরে বেরোলেই সব বয়সের নারী নির্যাতনের শিকার হতে পারে। এসব নির্যাতনের সামাজিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। শুধু কি ঘরের বাইরে; পরিসংখ্যানে দেখা যায়- প্রচুর নারী পারিবারিকভাবেও ঘরের ভেতর আপনজনের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নারী হয়ে জন্মানোটা যেন এক অভিশাপ।

আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের পরম মমতায় আগলে রাখার চেষ্টা করি। সেই আমি অন্য পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে উন্মত্ততায় অংশগ্রহণ করি, কিন্তু কেন? অনেকে অনেকভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন; কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।

নারী যখন মুখ খোলে, তখন সমাজের কদর্য চেহারাটা বেরিয়ে আসে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সামাজিক গণমাধ্যমে নারীর ‘মি-টু’ আন্দোলন অনেক পুরুষের মুখোশের আড়ালে লুকানো কুৎসিত চেহারা উন্মোচিত করেছে। এই আন্দোলনে বাইরের পৃথিবীতে নারী যতটা সোচ্চার, আমাদের মতো দেশগুলোয় ততটা নয়। কারণ সমাজের আরোপিত মূল্যবোধ নারীর কথা বলার অধিকারকেও সীমিত করে দিয়েছে।

বলা হয়ে থাকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান নারী নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর উপস্থিতি এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান। কিন্তু এই দৃশ্যমানতা নারীর নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

প্রতিদিন নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। সিনেমার পর্দায় ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক ছবি দেখলে মনটা ক্ষণিকের জন্য খারাপ হয়। কিন্তু এই সমাজে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটছে; সেসব ঘটনা আমাদের আন্দোলিত করে না।

সমাজবিজ্ঞানীরা নারী নির্যাতনের ঘটনাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, তা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। তারা বলেন, এর একটি কারণ হচ্ছে অসুস্থ মানসিকতা। কিন্তু এই অসুস্থ বা বিষাক্ত মানুষটি তো রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না! এক সময় বলা হতো, রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানুষটি বিপজ্জনক। আজ সে অবস্থাও বদলে গেছে।

লিঙ্গ, বৈষম্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের নারীরা নিরাপদ নয়। কিন্তু এই নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে না পারলে সুশাসনের অঙ্গীকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। গণতন্ত্রের প্রচেষ্টা হবে সুদূর পরাহত। সংসদে পঞ্চাশজন নারীর উপস্থিতি যথেষ্ট নয়।

এখানেও যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে- নারী পুরুষের করুণার ওপর নির্ভরশীল। নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য জীবন চলার পথে তাই পুরুষকে নারীর ওপর নির্ভরশীল করে তুলতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *