Site icon Kabinbd Blog

যে সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে

যে সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে:

মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরণের সম্পর্ক থাকে, যেমন:

কিছু সম্পর্ক সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে পারে। এর কিছু কারণ হল:

যে সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলোকে ধরে রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

মনে রাখবেন, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

পুরোনো প্রেমিকারা হারিয়ে যায় জীবন থেকে। প্রথমে কষ্ট হলেও একসময় সয়ে যায় সবকিছু। হারিয়ে যায় বাবা-মা-ভাই-বোন, হারিয়ে যায় রক্তসম্পর্কিত ও সম্পর্কহীন অনেক মানুষ। আমরা কষ্ট পাই, জীবন চলে জীবনের মতো। কিন্তু কিছু কিছু সম্পর্ক আছে বেশ অদ্ভুত। জীবনে ক্ষণিকের জন্য এলেও তাঁদের প্রভাব থাকে সারা জীবন। একান্ত আপন সময়ে হয়তো দীর্ঘশ্বাস পড়ে তাঁদের জন্য। বলছি সেই সব মানুষের কথা, যাঁরা রক্তসম্পর্কীয় না হয়েও আপন হয়ে থাকেন। আপন করে নেন। শেখান জীবন চলার পথের মূল মন্ত্র।

আমার জীবনে ছিলেন শান্ত কাকা। রক্তসম্পর্কীয় নন, পাড়াতো কাকা। লেখাপড়া নেই। রিকশা চালাতেন। শান্ত কাকা আমাদের শেখাতেন দূরের শহর আর বিচিত্র জীবনের কথা। সান্তাহার নামের একটা রেল জংশন আছে আমাদের দেশে, তার গল্প প্রথম শুনি শান্ত কাকার কাছেই। অনেক দিন তিনি এলাকায় উপস্থিত ছিলেন না। হঠাৎ এক রাতে ফিরে পরদিন দেখা করতে এসেছিলেন। দেখেই আমরা ছটফট করে উঠলাম। কোথায় ছিলেন, কী করেছেন এমন শত প্রশ্নের মুখেও শান্ত কাকা শান্ত থেকে মিটিমিটি হেসে বললেন, সান্তাহার গিয়েছিলাম। বিরাট জংশন। দেখলাম।

নিজের নামের সঙ্গে মিল থাকায় আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি মশকরা করছেন। কিন্তু জংশন শুনে বুঝলাম বিষয়টি মশকরা নয়। তারপর বাবার কাছে জেনে নিলাম সান্তাহার জংশনের কথা। তেমন করেই শান্ত কাকা আমাদের জানিয়েছিলেন, হিলি নামের একটা জায়গা আছে। তার একদিকে বাংলাদেশ অন্যদিকে ভারত। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই যাওয়া যায় ভারতে। আমরা সে গল্প শুনে শিহরিত হয়ে উঠি। অনেক অনেক দিন পর তিনি উদয় হতেন আর আর জানাতেন, গিয়েছিলাম বেলকুচি। এই যে লুঙ্গি দেখছিস সেগুলো ওখানে বানানো হয়। হয়তো কখনো বলতেন, বল তো স্মৃতিসৌধ কোথায়? ভুলভাল নাম বললে ধমক দিয়ে তিনি জানাতেন, ঢাকার সাভার। গেছিলাম তো।

আমাদের কৌতূহল বাড়ত তাঁর এই ভ্রমণের কথা শুনে। সেই ছোটবেলায় আমরা শান্ত কাকার ভ্রমণের গল্প শুনে শুনে প্রায় পুরো দেশে মানস ভ্রমণে বেরিয়ে পরতাম। বড় হয়ে অনেক জায়গায় গিয়ে প্রথমেই মনে পড়েছে শান্ত কুমার রায় নামের সেই নিরক্ষর মানুষটির কথা, যিনি আমাদের অজান্তেই আমাদের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন ভূগোল জানার। পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন ছকের বাইরে বেরিয়ে পড়ার।

একদিন শান্ত কাকা জানালেন, একটা প্রেম হয়েছে তাঁর। মেয়ে কিছুটা লেখাপড়া জানে। চিঠি লিখতে বলেছে। কিন্তু তিনি তো লিখতে জানেন না। চিঠি লিখে দিতে হবে আমাকে। শেষে বেবি লজেন্সের বিনিময়ে রফা হয় আমি লিখব। সে প্রেম তাঁর টেকেনি। বলা বাহুল্য, তিনি বিয়ে করেছিলেন ঠিক কতটি, আমরা জানি না। কিন্তু একবার ভীষণ গোলমালে বোঝা গেল, তিনি নতুন বিয়ে করেছেন। আমরা মহাসমারোহে গেলাম নতুন বউ দেখতে। সে বিয়েও টেকেনি।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি রাজশাহীতে, তখন স্টেশন মোড়ে একদিন শুনলাম আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। চমকে গেলাম। শান্ত কাকা রিকশার ওপরে বসে হাসছে। কাছে গেলে বললেন, চল। তোর মেসে রেখে আসি। আমি খুব ঠান্ডা কণ্ঠে বললাম, কই হারাও মাঝে মাঝে? সেই একবারই তিনি আমার মেসে গিয়েছিলেন আমাকে নিজের রিকশার যাত্রী বানিয়ে। রাজশাহীতে ছিলেন অনেক দিন, কিন্তু আর দেখা হয়নি। তিনি আমার মেস জানার পরও আর আসেননি। বহুদিন পর একবার বাড়িতে তাঁকে ধরে বলেছিলাম, মেসে যাওনি কেন? তিনি জানালেন, অনেক ছাত্র থাকে না। আমি একটা মূর্খ মানুষ। কে কী বলবে। তাই যাইনি।

শান্ত কাকা এখনো আছেন। ভূগোলের নেশা ধরিয়ে দিয়ে তিনি থিতু হয়েছেন গাইবান্ধায়। সংসার হয়েছে।

আমার জীবনে ছিলেন গোলেনুর বেগম। পরে তিনি গোলেনুর বেওয়া। কিন্তু আমাদের কাছে ছিলেন, বেটি। মানে ফুফু। মানে পিসিমা। আজ থেকে ৩০–৩৫ বছর আগের এক রাতে কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে গোলেনুর বেগমের পুরো পরিবার চলে এসেছিল আমাদের বাড়ি। কীভাবে, সেটা জানি না। তবে জানি, তাঁদের বাড়ি ভেঙে গিয়েছিল নদীতে। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আমাদের বেটি হিসেবেই ছিলেন। গত অক্টোবর মাসের দুর্গাপূজায় আমি বাড়ি ফিরে তাঁর কিছু ছবি তুলেছিলাম। জানতাম না যে এই ছবিই তাঁর তোলা শেষ ছবি হবে। মাস দুয়েক আগে তিনি মারা গেছেন। বুকের ভেতর থেকে হু হু করে কান্না বেরিয়ে এসেছিল তাঁর মৃত্যু সংবাদে।

গোলেনুর বেগম আমাদের সব ভাইবোনকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। হাতে তুলে খাইয়েছেন। বড় করেছেন। আমার বোনদের বিয়েতে আনন্দ করেছেন, বিদায়ে কেঁদেছেন। আমার বিয়ে দেখেছেন। নিজের মনে করে বউকে বরণও করেছেন। তারও আগে আমাদের ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার শিক্ষাও দিয়েছেন তিনি। আমার ঠাকুর দাদা ছিলেন বৈষ্ণব। কিন্তু গোলেনুর বেগমকে অনুমতি দিয়েছিলেন সকালবেলা নিজের নাশতা বানানোর, তিন–চার বেলা চা বানানোর। অথচ গোলেনুর বেগম নামাজ পড়তেন নিয়ম করে, রোজা রাখতেন। আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ হলে, শুনেছি, তিনি শিরনি দিয়েছিলেন মসজিদে। তাঁর কোথাও বাধেনি, আমাদেরও আটকায়নি।

চার–পাঁচ বছর ধরে তিনি বোরকা পরতেন। সেটা পরেই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন, আনাজ কুটে দিতেন। হ্যাঁ, আনাজ শব্দটি আমি তাঁর কাছেই প্রথম শুনি। আমি দেখেছি সেই ছোটবেলা থেকে, গোলেনুর বেগম খুব মিহি করে লাউ কাটতে পারতেন। শীতের সকালে ধনেপাতা দিয়ে সে লাউয়ের স্বাদ এখনো ভুলিনি আমরা কেউ। কুড়িগ্রামের কিছু আঞ্চলিক খাবারের রেসিপিও তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা-কাকিমাদের। এই গোলেনুর বেগমের জন্যই হয়তো আমাদের বই পড়ে ‘অসাম্প্রদায়িক’ শব্দটির বৈশিষ্ট্য শিখতে হয়নি। আমাদের ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে, রান্নাঘরে গোলেনুর বেগম আর তাঁর সন্তানদের যাতায়াত ছিল অবারিত। এর হাত ধরেই হয়তো সবার সঙ্গে মেশার শিক্ষাটা পেয়েছিলাম। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নয়।

বড় হওয়ার আগে আমার বাবার সঙ্গে গল্প করার একটা অভ্যাস ছিল। বাবাও জানিয়েছেন, তার এমন কোনো এক চাচা ছিলেন, যিনি ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন’। মধ্যরাতে বাড়ির মানুষদের জন্য ডাক্তার বদ্যি ডাকা থেকে শুরু করে বাড়ির বউদের নাইওর নিয়ে যাওয়া, বাড়ির মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ম করে বছরান্তে নাইওর আনার কাজটা তাঁর ওপরেই ছিল। একদিন সে চাচা উধাও হয়ে যান কোথায়, কেউ জানে না।

দীর্ঘদিনের এক সহকর্মী বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি, কুষ্টিয়ায় তাদের পাড়ায় এক ‘বড় ভাই’ ছিলেন, আপদে–বিপদে তিনি কোথায় থেকে উদয় হতেন কেউ জানত না। কাজ শেষে চলে যেতেন নীরবে। পাড়ার ছেলেদের খেলাধুলা, পড়াশোনায় সহায়তা করা থেকে বিপথে যাওয়ার হাত থেকে তিনিই রক্ষাকর্তা ছিলেন।

খুঁজলে এই চাচা, বড় ভাই, কাকা বা বেটিদের দেখা পাওয়া যেত আমাদের চারদিকেই। কিন্তু স্বতন্ত্র হতে হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এই একুশ শতকের জীবনে সে চরিত্রগুলো বিলুপ্ত প্রায়। খুব ছোট ছোট এ চরিত্রগুলো নিজের গরজে পাড়ার বা গ্রামের তরুণদের পথ দেখাতেন, সামাজিক করে তুলতেন, ক্ষেত্রবিশেষে পরিবারের সঙ্গে তরুণদের যোগাযোগের সাঁকো হয়ে কাজ করতেন, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ—পরিবারের বাইরে সে শিক্ষাটা দিতেন, প্রেম–ভালোবাসা সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণাটা তরুণেরা পেত তাদের কাছ থেকেই। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার, সেটা ছিল লিডারশিপ। তরুণদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া শেখাতেন তাঁরা। সমাজের তরুণ সদস্যদের সঙ্গে ছিল তাঁদের নিবিড় যোগাযোগ। ফলে তাঁরা জানতেন, কাকে দিয়ে কোন কাজটা ভালো হবে। তাকে দিয়ে প্রয়োজনে সে কাজটা করিয়ে নিতে ওস্তাদ ছিলেন সেই রহস্যময় চরিত্রেরা।

আমাদের সমকালীন সামাজিক ইতিহাস লেখার প্রবণতা নেই। সে জন্য সমাজ বদলের কারণগুলোও আমরা খুঁজে পাই না ঠিকমতো। আমরা ধীরে ধীরে আমাদের সমাজের প্যাটার্ন এমনভাবে তৈরি করে ফেলেছি যে ‘সেই বড় ভাই, কাকা, বেটি’র মতো নিঃস্বার্থ নেতারা, নীরব স্রোতের মতো সমাজের কোরামিন ট্যাবলেটের মতো মানুষগুলোর আদৌ আর জন্ম হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

রজত কান্তি রায়

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৮: ০৮

ছবি: ফটোগ্রাফিরেন্ডি, পেকজেলস ডট কম

matrimony

https://www.kabinbd.com/

 

Exit mobile version